রমজান মাস এলেই বেশি বেশি এবাদত বন্দেগি করতেন রাসুল (সা.)। বেশি বেশি নফল নামাজ, তাসবিহ তাহলিল, দান খয়রাত করতেন তিনি। অত্যন্ত আগ্রহ ও ব্যাকুলতার সঙ্গে সেহরি ও ইফতার করতেন। রোজা ভাঙার সময় হলে দ্রুত ইফতার করে নিতেন, সেহরি করতেন অনেক দেরিতে। সেহরি সমাপ্ত করার কিছুক্ষণ পরেই পূব আকাশে আলো ফুটে যেত। ইফতার করতেন খুব পরিমিত। বেশিরভাগ সামান্য ভেজা বা শুকনো খেজুর আর পানি দিয়ে ইফতার করতেন তিনি। ভেজা খেজুর সেহরিতে পছন্দ করতেন তিনি। সেহরি ও ইফতারে কখনো জাঁকজমক ছিল না তার।
রমজানে রাসুলের এ আচরণ বিষয়ে বিভিন্ন হাদিসে উল্লেখ পাওয়া যায়। এরকম কয়েকটি হাদিস হলো:
হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, ( ﻛﺎﻥ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭ ﺳﻠﻢ ﻳﻔﻄﺮ ﻗﺒﻞ ﺃﻥ ﻳﺼﻠﻲ ﻋﻠﻰ ﺭﻃﺒﺎﺕ، ﻓﺈﻥ ﻟﻢ ﺗﻜﻦ ﺭﻃﺒﺎﺕ ﻓﺘﻤﻴﺮﺍﺕ، ﻓﺈﻥ ﻟﻢ ﺗﻜﻦ ﺗﻤﻴﺮﺍﺕ ﺣﺴﺎ ﺣﺴﻮﺍﺕ ﻣﻦ ﻣﺎﺀ ) রাসুল (সা.) নামাজ আদায়ের আগে কয়েকটি ভেজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন, যদি ভেজা খেজুর না থাকত, তবে সাধারণ শুকনো খেজুরই গ্রহণ করতেন। যদি তাও না থাকত, তবে কয়েক ঢোক পানিই হত তার ইফতার। [তিরমিজি : ৬৯৬]
আরেকটি বর্ণনায় পাওয়া যায়, উপরোক্ত কিছুই যদি না থাকে, তবে রোজাদার যে কোনো হালাল খাদ্য দিয়ে ইফতার করে নিবে। তবে, খাদ্যই যদি না থাকে, তাহলে ইফতারের নিয়ত করবে। ইফতারের নিয়তই হবে তার জন্য ইফতার।
আবু আতিয়া হতে বর্ণিত, আমি এবং মাসরুক আয়েশার (রা.) নিকট উপস্থিত হলাম। মাসরুক তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন: মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুই সাহাবি উপস্থিত হয়েছে, যাদের কেউ কল্যাণে পশ্চাৎবর্তী হতে আগ্রহী নয়; তাদের একজন মাগরিব ও ইফতার উভয়টিকেই বিলম্ব করে, অপরজন দ্রুত করে মাগরিব ও ইফতার। আয়েশা বললেন: কে মাগরিব ও ইফতার দ্রুত করে? বললেন: আব্দুল্লাহ। আয়েশা উত্তর দিলেন: রাসুল (সা.) এভাবেই রোজা পালন করতেন। [মুসলিম : ১০৯৯।]
আব্দুল্লাহ বিন আবি আউফা হতে বর্ণিত, ( ﻛﻨﺎ ﻣﻊ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭ ﺳﻠﻢ ﻓﻲ ﺳﻔﺮ ﻓﻲ ﺷﻬﺮ ﺭﻣﻀﺎﻥ، ﻓﻠﻤﺎ ﻏﺎﺑﺖ ﺍﻟﺸﻤﺲ ﻗﺎﻝ : ﻳﺎ ﻓﻼﻥ ﺍﻧﺰﻝ ﻓﺎﺟﺪﺡ ﻟﻨﺎ ! ﻗﺎﻝ : ﻳﺎ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺇﻥ ﻋﻠﻴﻚ ﻧﻬﺎﺭﺍً ! ، ﻗﺎﻝ : ﺍﻧﺰﻝ ﻓﺎﺟﺪﺡ ﻟﻨﺎ ! ، ﻗﺎﻝ : ﻓﻨﺰﻝ ﻓﺠﺪﺡ، ﻓﺄﺗﺎﻩ ﺑﻪ ﻓﺸﺮﺏ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭ ﺳﻠﻢ ﺛﻢ ﻗﺎﻝ ﺑﻴﺪﻩ : ﺇﺫﺍ ﻏﺎﺑﺖ ﺍﻟﺸﻤﺲ ﻣﻦ ﻫﺎ ﻫﻨﺎ ﻭﺟﺎﺀ ﺍﻟﻠﻴﻞ ﻣﻦ ﻫﺎ ﻫﻨﺎ ﻓﻘﺪ ﺃﻓﻄﺮ ﺍﻟﺼﺎﺋﻢ )
একবার, রমজান মাসে আমরা রাসুলের সাথে সফরে ছিলাম। সূর্য অস্তমিত হলে তিনি বললেন, হে অমুক ! নেমে এসে আমাদের জন্য ছাতু ও পানি মিশ্রিত ইফতার পরিবেশন কর। লোকটি বলল: হে আল্লাহর রাসুল! এখনও তো দিবসের কিছু বাকি আছে। রাসুল পুনরায় বললেন: নেমে এসে আমাদের জন্য ছাতু ও পানি মিশ্রিত ইফতার পরিবেশন কর। বর্ণনাকারী বলেন: সে নেমে এসে ছাতু ও পানির ইফতার প্রস্তুত করে রাসুলের সামনে উপস্থিত করলে তিনি তা গ্রহণ করলেন। অতঃপর তিনি হাতের ইশারা দিয়ে বললেন: সূর্য যখন এখান থেকে এখানে অস্ত যাবে এবং রাত্রি আগত হবে এতটুকু অবধি, তখন রোজাদার রোজা ভাঙবে। [বোখারি : ১৯৪১, মুসলিম : ১১০১।]
জনৈক সাহাবির সূত্র ধরে আব্দুল্লাহ বিন হারেস বর্ণনা করেন, আমি রাসুলের নিকট হাজির হলাম, তিনি সেহরি খাচ্ছিলেন। রাসুল বললেন: নিশ্চয় তা বরকত স্বরূপ, আল্লাহ পাক বিশেষভাবে তা তোমাদেরকে দান করেছেন, সুতরাং তোমরা তা ত্যাগ কর না। [নাসায়ি : ২১৬২, হাদিসটি সহি।]
যায়েদ বিন সাবেত হতে বর্ণিত, আমরা রাসুলের সাথে সেহরি খেলাম, অতঃপর তিনি সালাতে দণ্ডায়মান হলেন। আমি বললাম: সেহরি ও আজানের মধ্যবর্তী সময়ের স্থায়িত্ব কতটুকু? তিনি বললেন: পঞ্চাশ আয়াত তেলাওয়াত পরিমাণ দৈর্ঘ্য। [বোখারি : ১৯২১।]
বিলম্বে সেহরি গ্রহণ রোজার জন্য সহজ, রোজাদারের জন্য প্রশান্তিকর; এবং বিলম্বে সেহরি গ্রহণের কারণে ফজরের সালাত ছুটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে না। আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, মুমিনের উত্তম সেহরি শুকনো খেজুর। [আবু দাউদ : ২৩৪৫, হাদিসটি সহি।]
আনাস রা. হতে বর্ণিত, ( ﻗﺎﻝ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭ ﺳﻠﻢ - ﻭﺫﻟﻚ ﻋﻨﺪ ﺍﻟﺴﺤﻮﺭ :- ﻳﺎ ﺃﻧﺲ ﺇﻧﻲ ﺃﺭﻳﺪ ﺍﻟﺼﻴﺎﻡ، ﺃﻃﻌﻤﻨﻲ ﺷﻴﺌﺎً، ﻓﺄﺗﻴﺘﻪ ﺑﺘﻤﺮ ﻭﺇﻧﺎﺀ ﻓﻴﻪ ﻣﺎﺀ، ﻭﺫﻟﻚ ﺑﻌﺪ ﻣﺎ ﺃﺫﻥ ﺑﻼﻝ ) রাসুল (সা.) সেহরিকালে আমাকে উদ্দেশ করে বলেছেন, হে আনাস, আমি রোজা রাখতে আগ্রহী। আমাকে কিছু আহার করাও। আমি তার সামনে শুকনো খেজুর ও একটি পাত্রে পানি উপস্থিত করলাম। বেলালের (প্রথম) আজানের পর তিনি সেহরি গ্রহণ করেছিলেন। [নাসায়ি : ২১৬৭]
রাসুল ইফতার করতেন দ্রুত। আনাসের (রা.) স্পষ্ট হাদিস এ বিষয়ের উৎকৃষ্ট প্রমাণ, তিনি বলেন: আমরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে, এমনকি এক ঢোক পানি দিয়ে হলেও, ইফতার করা ব্যতীত মাগরিবের সালাত আদায় করতে দেখিনি। [ইবনে হিববান : ৩৫০৪, শাইখাইনের শর্ত অনুসারে হাদিসটির সূত্র বর্ণিত।]
আব্দুল্লাহ বিন উমর (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল বলেছেন— ﺗﺴﺤﺮﻭﺍ ﻭﻟﻮ ﺑﺠﺮﻋﺔ ﻣﻦ ﻣﺎﺀ এক ঢোক পানি দ্বারা হলেও, তোমরা সেহরি গ্রহণ কর। [ইবনে হিববান : ৩৪৭৬, হাদিসটি হাসান।]
আমর বিন মায়মুন (রা.) বলেন: মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিগণ ছিলেন সকলের চেয়ে সর্বাধিক দ্রুত ইফতারকারী, এবং বিলম্বে সেহরি গ্রহণকারী। [আব্দুর রাজ্জাক : ৭৫৯১]
এই হলো সেহরি ইফতার গ্রহণের সুন্নতি তরিকা। এই হলো রাসুলের (সা.) আদর্শ। কিন্তু এখন মধ্যপ্রাচ্যের তো বটেই বাংলাদেশেও ইফতারের সময় যে আয়োজন করা হয় তাতে রোজা সঠিকভাবে পালন করাতো হয়-ই না বরং পবিত্র রমজান একটি অপচয়ের মাসে পরিণত হয়! সেহরিতেও তেমনি জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন লক্ষ্য করা যায়।
সংযমের মাসে এই অতিরিক্ত ভোগপ্রবণতার সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরাও জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়। রোজাদার ক্রেতা বা বিক্রেতা উভয়েই এভাবে অশেষ সওয়াব হাসিলের সুযোগ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করে।
শুধু তাই নয়, কোথাও কোথাও দেখা যায়, মানুষ হারাম ও অবৈধ খাদ্য দিয়ে ইফতার ও সেহরি গ্রহণ করছে, সেহরি ও ইফতারের পিছনে ব্যয় করছে অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ।
আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন।
Post a Comment