নারীদের মসজিদে গমন নিয়ে ফিকাহবিদদের মতামত : প্রথমদিকের কিছু ওলামায়ে কেরাম বৃদ্ধাদের জন্য মাগরিব ও এশার সময় ফিতনামুক্ত হওয়ার কারণে মসজিদে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। পরবর্তী ফিকাহবিদরা ফিতনার ব্যাপকতার কারণে যুবতী ও বৃদ্ধা সবার জন্য সব নামাজে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেছেন। (শরহুস সগির : ১/৪৪৬, আল মাজমু : ৪/১৯৮, আল মুগনি : ২/১৯৩)
হানাফি মাজহাবের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বাদায়েউস সানায়ে’তে বলা হয়েছে যে যুবতী নারীদের মসজিদে যাওয়া ফিতনা। (বাদায়েউস সানায়ে : ১/১৫৬)
আল্লামা ইবনে নুজাইম মিসরি ও আল্লামা হাসকাফি (রহ.) বলেন, বর্তমান যুগে ফিতনার ব্যাপক প্রচলন হওয়ায় ফতোয়া হলো, সব নারীর জন্যই সব নামাজ মসজিদে গিয়ে জামাতে আদায় করা মাকরুহে তাহরিমি। (আল বাহরুর রায়েক : ১/৬২৭-৬২৮, আদ্দুররুল মুখতার : ১/৩৮০)
নারীদের মসজিদে যাওয়া সম্পর্কে বর্ণিত হাদিসের ব্যাখ্যা
এক. হজরত ইবনে ওমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর বান্দিদের আল্লাহর মসজিদ থেকে নিষেধ কোরো না।’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস : ৪৪২; আবু দাউদ, হাদিস : ৫৬৬)
উল্লিখিত হাদিসের ব্যাখ্যা হলো, ইসলামের প্রথম যুগে নারীরা মসজিদে যাওয়ার অনুমতি চাইলে তাদের নিষেধ করা হতো না। ওই নির্দেশ সাময়িক ও শর্তসাপেক্ষ ছিল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের কারণে ও শর্ত না পাওয়ার কারণে এখন নিষেধ করাটাই সুন্নত। কারণ রাসুল (সা.)-এর যুগ ওহি নাজিলের যুগ ছিল। তাই নারীরা যাতে বিভিন্ন সময় অবতীর্ণ আয়াত ও শরিয়তের বিভিন্ন বিধান সরাসরি রাসুল (সা.) থেকে ভালোভাবে শিখে নিতে পারেন, সে জন্য নারীদের মসজিদে আসতে নিষেধ করা হয়নি। কিন্তু পরে এই প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যাওয়ায় সাহাবায়ে কেরাম নিষেধ করে দেন।
আল্লামা ইবনে হাজর (রহ.) বলেন, এ হাদিসে যদিও স্বামীকে নিষেধ করতে বারণ করা হয়েছে, এ বারণ কঠোর নিষেধ নয়, বরং তা হলো সাধারণ নিষেধ। এ জন্যই স্বামী অনুমতি দিলেও ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধান ফিতনার আশঙ্কায় নারীদের মসজিদে আসা নিষেধ করতে পারবেন। (মিরকাতুল মাফাতিহ : ৩/৮৩৬)
দুই. নারীদের মসজিদে যাওয়া সম্পর্কে দ্বিতীয় হাদিস হলো, উম্মে আতিয়া (রা.) বলেন, আমাদের আদেশ করা হয়েছে যে আমরা যেন ঋতুবতী পর্দানশিন নারীদেরও ঈদের ময়দানে নিয়ে যাই। যাতে তাঁরা মুসলমানদের জামাত ও দোয়ায় শরিক থাকতে পারেন। তবে ঋতুবতী নারীরা নামাজের জায়গা থেকে আলাদা থাকবে। জনৈকা সাহাবিয়া বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের অনেকের তো চাদরও নেই। রাসুল (সা.) বললেন, তাকে যেন তার বান্ধবী নিজ চাদর দিয়ে সাহায্য করে। (বুখারি শরিফ, হাদিস : ৯৭৪)
ব্যাখ্যা : এখানেও আগের উত্তরটি প্রযোজ্য। আর তা হলো, নারীরা যাতে ঈদের দিনের যাবতীয় শরয়ি বিধান সরাসরি রাসুল (সা.) থেকে ও রাসুলের ঈদের খুতবায় যাবতীয় ওয়াজ-নসিহত ও মাসয়ালা-মাসায়েল ভালোভাবে শিখে নিতে পারে, সে জন্য রাসুল (সা.)-এর যুগে ঈদগাহে আসার অনুমতি ছিল। কিন্তু পরে এই প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যাওয়ায় সাহাবায়ে কেরাম নিষেধ করে দেন।
ইমাম তাহাবি (রহ.) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, ইসলামের প্রাথমিক যুগে নারীদের জন্য ঈদগাহে যাওয়ার অনুমতি ছিল, যাতে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি দেখা যায়। মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য দেখে ইসলামের দুশমনদের যেন চক্ষুশূল হয়। কিন্তু আজ যেহেতু সেই পরিস্থিতি নেই এবং সংখ্যাধিক্য দেখানোর জন্য পুরুষরাই যথেষ্ট, তাই ওই বিধানও প্রযোজ্য হবে না। (ফাতহুল বারি : ২/৪৭০)
আল্লামা ইবনুল হাজ মালেকি (রহ.) হাদিসটির ব্যাখ্যায় বলেছেন, বিধানটি রাসুল (সা.)-এর যুগের বৈশিষ্ট্য। পরবর্তী যুগের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়। (আল মাদখাল : ২/২৮৮)
দুটি সন্দেহ ও তার নিরসন
সন্দেহ এক. কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, যদি বর্তমান যুগে নারীদের মসজিদে যাওয়া ফিতনার আশঙ্কায় নিষেধ হয়, তাহলে রাসুল (সা.) স্পষ্ট এ কথা বলে যাননি কেন যে আমার যুগের পর নারীদের মসজিদে আসা নিষেধ?
নিরসন : রাসুল (সা.) শরিয়তের অসংখ্য বিধানাবলির ক্ষেত্রেই এরূপ করে গিয়েছেন যে তা স্পষ্ট করে বলে যাননি। তিনি জানতেন ও বুঝতেন যে প্রিয় সাহাবি তাঁর সব কথার মর্ম ও উদ্দেশ্য বুঝেই পরবর্তী সময়ে আমল করবেন। তাই সব কথা স্পষ্ট করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। যেমন—রাসুল (সা.)-এর পর আবু বকর (রা.)-কে খলিফা বানানোর কথা স্পষ্ট বলে যাননি। কেননা তিনি জানতেন যে তাঁর সাহাবিরা বিভিন্ন আকার-ইঙ্গিতে তাঁর উদ্দেশ্য বুঝে নিয়েছেন। এখন আর তাদের তা স্পষ্ট করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমাদের আলোচিত বিষয়টিও তদ্রূপ। নারীদের ফিতনা ও নারীদের পর্দা-সংক্রান্ত শত শত হাদিস থাকা সত্ত্বেও সাহাবিরা এ বিষয়ে রাসুল (সা.)-এর ইচ্ছা বুঝবেন না, তা অসম্ভব।
সন্দেহ দুই, অনেক ভাই বলে থাকেন যে মক্কা-মদিনার হারামাইন শরিফে নারীরা মসজিদের জামাতে অংশগ্রহণ করে থাকেন।
নিরসন : আসলে হারামাইনে কিছু বিশেষ প্রয়োজনের কারণে নারীদের জামাতে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তা হলো, নারীদের যেহেতু মক্কার মসজিদে হারামে তাওয়াফের জন্য আসতে হয় এবং মদিনার মসজিদে নববিতে জিয়ারতের জন্য তাঁরা এসে থাকেন। এ অবস্থায় নামাজের আজান হয়ে গেলে আর বের না হয়ে তাঁরা মসজিদের জামাতে অংশগ্রহণ করে থাকেন। ওলামায়ে কেরাম এর অনুমতি দিয়েছেন। তবে শুধু কেবল জামাতে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে নারীদের হারামাইনে যাওয়ার অনুমতি নেই। বর্তমানে না জেনে অনেক মহিলা শুধু নামাজের জন্যই হারামাইনে উপস্থিত হয়ে থাকেন, তা ঠিক নয়। (ইলাউস সুনান : ৪/২৩১) (সমাপ্ত)
লেখক : ফতোয়া গবেষক
ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশ
Post a Comment