Register

Win 10.00$

গান কী না শুনলেই নয়?

Be the first to comment!

আপু/ভাইয়া, ছোট্ট একটা বাচ্চা, বয়স দুই কি তিন, বীরদর্পে হাটা দিল রাস্তা পার হবে বলে। তুমি পিছন থেকে ধরে ফেললে। সে যতই দাবী করুক সে সব গাড়ি চেনে এবং সে দেখেশুনে পার হতে পারবে তুমি কি তাকে ছেড়ে দেবে? সে এবার যদি বলে রাস্তা তো পার হবার জন্যেই তবুও কি তুমি তাকে ছেড়ে দেবে? আমি হলে ছাড়তাম না। কারণ হয়ত সে পার হতেও পারে কিন্তু সম্ভাবনা বেশি যে সে পড়ে যাবে বা খুব জোরে চলা একটা ট্রাকের সাথে ধাক্কা খাবে। এমনও হতে পারে বাচ্চাটাকে বাচাঁতে গিয়ে একটা গাড়ি হার্ডব্রেক করলো আর সেটা উলটে গেল। ব্যস্ত রাস্তা হলে তো কথাই নেই সেটাকে পিছন থেকে আরো কয়েকটা গাড়ি ধাক্কা মারবে। এ সব কিছুই যে হবে এমন কথা নেই কিন্তু হওয়ার সম্ভাবনা বেশি কারণ দু’তিন বছরের একটা শিশুর নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই। সে যতই দাবী করুক তার সামর্থ্যের কথা – আসলে তার সেটা নেই এবং সে সেটা জানে না। আমরা মানুষেরা আসলে এই ছোট্ট বাচ্চাটার মত আমরা ভাবি আমরা জানি আমাদের জন্য কি ভাল; আসলে জানিনা।
সুর আসলে কি? খেয়াল করলে দেখা যাবে এটা আসলে সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি – এ সাতটা নোটের অসংখ্য পারমুটেশন-কম্বিনেশন। কিভাবে সাজালে এটা মনকে ছুঁয়ে যাবে তা খুব মেধাবী কিছু মানুষের বিমূর্ত সৃষ্টি। এটা কিন্তু টেইলর-মেড, এমনভাবে ডিজাইন করা যেন তা মানুষের মনে দাগ ফেলে, তাকে আলোড়িত করে। কিন্তু প্রাকৃতিক সুর যেমন ঝর্ণার শব্দ বা পাখির ডাক কিন্তু মানুষকে মুগ্ধ করে কিন্তু মনকে ঘন্টার পর ঘন্টা ভুলিয়ে রাখেনা। এই সুর মানুষের আত্মার জন্য সেই কাজ করে যা মদ শরীরের জন্য করে, সেটা হল ভুলিয়ে রাখা। গান-বাজনা মানুষকে সেই অমোঘ সত্যটা ভুলিয়ে রাখে যে এই পৃথিবীর সময় খুব কম, একে ছেড়ে আমাদের চলে যেতে হবে অন্য ধামে। আর সেখানে ভাল থাকার জন্য আমাদের অনেক কিছু করতে হবে – জানতে হবে, শিখতে হবে, মানতে হবে। কিন্তু কাউকে যদি ভুলিয়ে রাখা যায় সেই অবধারিত সত্য সম্পর্কে তবে সে না সতর্ক হবে না তার উচিত কাজগুলো সে করবে। তুমিই বল গান আর ক্বুরান কি এক সাথে শোনা যায়? কোন গানের অনুষ্ঠানের শুরুতে কি কেউ ক্বুরান তিলাওয়াত করে? তোমাকে আল্লাহর বাণী ক্বুরান থেকে দূরে রাখার জন্যই যে নিত্য-নতুন সুর আবিষ্কৃত হয় তা কি তুমি বোঝনা? এক মিউজিক তুমি কতবার শুনতে পারবে – কয়েকশ বার? হাজারবার? তারপর তুমি বীতশ্রদ্ধ হয়ে যাবে। তোমার মন নতুন কম্বিনেশন খুঁজবে। তোমার অসম্ভব প্রিয় সুরটি তোমার অসহ্য লাগবে। অথচ তুমি কি জান সুরা ফাতিহা একজন মানুষ শুধু ফরজ নামাজেই ১৭ বার পড়ে, নফল মিলিয়ে তা ৩০ ছাড়িয়ে যায়। এটা সে ৩৬৫ দিন পড়ে, বছরের পর বছর পড়ে, তাও কিন্তু বিরক্তি আসেনা – একি নেহায়েত কাকতালীয় ব্যাপার?
মজার ব্যাপার হল নেশার যেমন স্তর বাড়ে সুরের ক্ষেত্রেও তাই। যে সিগারেট দিয়ে শুরু করে সে গাঁজা, চরস, কোকেইন, হিরোইন ধরে। মাদকের মানও বাড়ে, মাত্রাও। ঠিক তেমনি তুমি যদি ওয়ার্ল্ড মিউজিকের ক্রমবিবর্তন দেখ তাহলে দেখবে সুর শেষ হয়েছে অসুরে (ডেথ, থ্র্যাশ, ব্ল্যাক, স্লাজ মেটাল) আর ভালোবাসা শেষ হয়েছে ঘৃণা আর উন্মাদনায়। হালের ইংরেজি ব্যান্ডের গানগুলোর মধ্যে ধ্বংস, ধর্ষণ আর ধর্মহীনতার কেতন ওড়ে। এরা আল্লাহকে অস্বীকার করে কিন্তু শয়তানকে পূজা করে, অনুকরণ করে। শয়তানকে গানের কথায় ধারণ করে, স্টেজের অঙ্গভঙ্গীতে, মিউজিক ভিডিওগুলোতে, এলবামের কাভারে, পরণের গেঞ্জিতে, মুখের মুখোশে। এনিগমা থেকে শুরু করে আয়রন মেইডেন, ব্ল্যাক সাবাথ, লেড যেপেলিন… আর কত বলব?
বিলাস, ব্যভিচার, মাদক কিন্তু সঙ্গীতের হাত ধরে আসে। তুমি কি কখনো তোমার বাবাকে বলতে পারবে – “I want a double boom…. Together in my room”? অথচ এমটিভিতে এগান শুনতে শুনতে তুমি সেই গায়িকার উদ্দাম নাচ দেখছ, তোমার বাবাও হয়ত দেখছে, কেউ কিছু মনে করছে না। খুব বেশি লজ্জা লাগলে তুমি এক টিভিতে দেখছ, তোমার বাবার টিভি অন্য ঘরে। তোমাকে কি কেউ বলতে সাহস পাবে – “আসো আমার ঘরে, আমরা ঘরের দরজা বন্ধ করে রাত কাটাই” ? জেমস কিন্ত বলছে “চাল চালে আপনি ঘর” তুমি শুনছ, সুরের তালে তালে মাথা দুলাচ্ছ। কত নোংরা একটা কথা সুন্দর সুরে গিটার বাজিয়ে বলায় তোমার কত ভালো লাগছে! তোমার স্কুল পড়ুয়া ছোট বোনটি কি কখনো তোমার সামনে অন্য কোন ছেলেকে বলতে সাহস পাবে “আসো আমার শরীরে হাত দাও, আমাকে চুমু খাও” ? অথচ সেই মেয়েটি যখন গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে নাচের তালে তালে দশটা ছেলের দিকে তাকিয়ে গাইছে “যারা যারা টাচ মি টাচ মি, কিস মি কিস মি” তুমি খুশিতে হাততালি দিচ্ছ।
তুমি দাবি করতে পার তুমি ক্লাসিকাল গান শোন, এ সব গা-গরম গান তোমার ভালো লাগেনা। তুমি না হয় উতরে গেলে কিন্তু তোমার ভবিষ্যত প্রজন্ম? আমার বোন রবীন্দ্র শোনে সবসময় কিন্তু ভাগ্নে শোনে রিহানা! তুমি যদি বাঁধে ছোট একটা গর্ত করে অল্প পানি আসতে দাও তবে সেই ছোট্ট ছিদ্র কিন্তু ছোট্ট থাকবেনা, বড় হবে। যে বাধঁ ভাঙার আওয়াজ আজ চারদিকে পাওয়া যায় তার শুরু কিন্তু ছোট্ট একটা ফাটল দিয়েই।
পঞ্চাশের দশকে সারা পৃথিবীতে বছরে যে ক’টা এলবাম বের হত আজ শুধু বাংলাদেশেই তার চেয়ে বেশি বের হয়। পঞ্চাশের দশকে সারা পৃথিবীতে বছরে যে ক’টা রেপ হত আজ শুধু বাংলাদেশেই তার চেয়ে অনেক বেশি হয়।
শিল্প-সংষ্কৃতি অনেক এগিয়েছে, মানুষের মানসিকতা? জগজিত সিং-এর কন্সার্টের টিকিট বিক্রি হয় ১০,০০০ টাকায়। সেইসময় কুড়িগ্রামে একটা মেয়ে না খেতে পেয়ে গলায় দড়ি দেয়। এই ১০,০০০ টাকার মধ্যে কি সেই মেয়েটাকে শুষে খাওয়া টাকা নেই?
প্রযুক্তির কল্যাণে সুর ছড়িয়ে পড়েছে, তবে অসুরই বেশি। ললিতকলা মানুষকে বন্য করেছে, সভ্য করেনি। প্যারিস হিলটনকে কি তোমার সভ্য মনে হয়? ম্যাডোনাকে? ব্রিটনি স্পিয়ার্স? তোমার ভাই এল্টন জনের চমৎকার অনুকরণ করতে পারে, সে যে শুধু গানই নিয়েছে সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন নেয়নি কিভাবে নিশ্চিত হলে?
তুমি বলতে পারো এগুলো বাণিজ্যিকধারার গান। কিন্তু একটা জিনিসের বাণিজ্যিকিকরণ কখন হয়? যখন তা অনেক মানুষ কেনে। “সোনা বন্ধু তুই আমারে ভোঁতা দা দিয়া কাইট্যালা” টাইপের গান শুনে আর ভিডিও দেখে তৈরি হয় ঐ সব নরপশু যারা তিন বছরের বাচ্চাকেও রেহাই দেয়না। আমরা মুখ ফুটে কখনো এদের বাঁধা দিইনি। এই নোংরা বাণিজ্যিকিকরণের দায় তো আমাদের সুশীল সঙ্গীতের উপরেও বর্তায়, তাই নয় কি? তুমি হয়তো বলতে পারো রাগ ভৈরবীর তবলার বোল শুনে তোমার আত্মিক উন্নতি হয়। কিন্তু আমার যে সেই বোলের সাথে একজন নাচনেওয়ালীর কোমর দুলানো দেখতে ইচ্ছে করে। সপ্তাহখানেক পর সেই কোমর ধরে দেখতে ইচ্ছে করে। আর এই সমাজে আমার মত লোকই যে বেশি। বিশ্বাস করলে না? সুনীলের “সেই সময়” পড়ে দেখতে পার। আমাদের আজকের সমাজের সুপারস্টার বাঈজীদের উদ্ভব হল কিভাবে জানতে পারবে।
তুমি যদি ধর্মগুলোর মধ্যে Corruption pattern খেয়াল করে তাহলে দেখবে হিন্দুদের খোল-করতাল দিয়ে কীর্তন, খ্রিষ্টানদের পিয়ানো-গিটার দিয়ে ক্রিসমাস ক্যারল আর বাউলদের ঢোল-দোতারা দিয়ে মুর্শিদী গান সবগুলোতেই সঙ্গত-সহ-সঙ্গীতকে উপাসনার স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছে। আমরা এখন গানের সুরে মিলাদ করি। বাদ্যযন্ত্র যে হারাম এই বোধটা আমাদের ভিতর থেকে চলে গেলে আমাদের মসজিদগুলোতে দেখবে বাঁশি বাজিয়ে ডাকছে কিংবা হারমোনিয়াম বাজিয়ে মিলাদ। ওরা কি বলবে জানো? আমরা তো খারাপ কিছু করছিনা, আল্লাহর গুণগান করছি।
আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন তার কোন কিছুই absolute evil নয়। সুর-বাদ্যযন্ত্রেরও ভাল দিক আছে, যেমন তা আমাদের ভাললাগার একটা আবেশ দেয়। কিন্তু এটা আমাদের বিশ্বাস যে ইসলামের নিষিদ্ধ করা জিনিসগুলো আমাদের যতটুকু ভালো করে, তারচেয়ে খারাপ করে অনেক বেশি। আর সে জন্যই আমাদের বৃহত্তর ভালোর কথা চিন্তা করে আল্লাহ আমাদের সেটা নিষেধ করেছেন। তুমি হয়তো সেই শ্রেণীর মধ্যে পড়না বাদ্যযন্ত্র যাদের পশুর শ্রেণীতে নামিয়ে দেয়। কিন্তু একবার যখন কোন জিনিস নিষিদ্ধ হয় তখন তা পুরো মানব জাতির জন্যেই হয় – কোন ব্যক্তি বিশেষের জন্য তার অনুমতি থাকেনা। কেউ শরিয়তি নিয়মের উর্ধে নয়। বেশিভাগ মানুষের ক্ষেত্রে সুর আর ধর্ম একসাথে চলেনা। গানের আসর থেকে উঠে গিয়ে নামায পড়তে দেখেছ কাউকে? শিল্পীদের? শ্রোতাদের?
তুমি ভাবতে পারো কেন তুমি অন্যদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাবে শাস্তি পাবে? এটাই তো ইসলাম। তুমি তোমার ভালোলাগাকে আল্লাহর ভালোলাগার কাছে সঁপে দিলে। তোমার ইচ্ছেকে তাঁর ইচ্ছের অধীন করে দিলে। তুমি এই আশায় বুক বাঁধলে যা তুমি ছেড়েছ তার চেয়ে বহুগুণে তুমি ফেরত পাবে। একেই বলে আত্মসমর্পণ অর্থাৎ ইসলাম।
গান শোনা ইসলামে একদম হারাম তা বলা যাবেনা। মা শিশুকে গান গেয়ে ঘুম পাড়াতে পারে। স্ত্রী ভালোবেসে স্বামীকে গান শোনাবে তাতে দোষের কিছু নেই। ঈদ-বিয়ে ইত্যাদি পরবে ছোটরা গান গেতে পারে যাতে নোংরা কথা থাকবে না, বাজনা থাকবে না।
কিন্তু আমাদের যে কথাটা মনে রাখতে হবে সৃজনশীলতা মানুষকে দেয়া আল্লাহর অনেক বড় দান। এ দিয়ে পরমাণু বিদ্যুত তৈরি হয়েছে বটে, হিরোশিমা-নাগাসাকিও কিন্তু এরই অবদান। মোজার্টের সৃজনশীলতায় কার কি উপকার হয়েছে জানিনা, ইবনুল কাইয়িমের লেখা পড়ে অনেক মানুষ তাদের বিশ্বাস রক্ষা করতে পেরেছে। যে সৃজনশীলতা ধ্বংসের পথ খুলে দেয় তাকে আমরা চাইনা। যে শিল্পের পরিণাম একটা কল্যাণ আর শত অকল্যাণ তা থেকে দূরে থাকাই ভালো।
মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর লোকটিকে জিজ্ঞেস করতে পারবে সে কন্সার্টে যাবে কিনা? আমরা সবাই কিন্তু দিনকে দিন মৃত্যুর দিকে এগুচ্ছি। ওর সময় হয়ে এল বলে। আর আমাদেরটা আমরা জানিনা। যদি মরণকে সত্যি মানো তবে এমন কিছু করো যা মরণের পরেও কাজে আসবে। আর সেগুলো করতে গেলে দেখবে সময় কত কম। সময় আসলেই কম।
– শরীফ আবু হায়াত অপু

  • 0Blogger Comment
  • Facebook Comment

Post a Comment

ads

Contact Form

Name

Email *

Message *

ads

Win 10.00$