(কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের অবলম্বনে মোঃ মাসুদুল ইসলাম ইব্রাহীমের সম্পাদনা) আহনাফ বিন কায়েস বনু তামিম গোত্রের সর্দার। তার আসল নাম “যাহহাক” কিন্তু তার পায়ে clubfoot রোগের কারনে কিছুটা বাঁকা ছিলো তাই সবাই তাকে “আহনাফ” বলে ডাকতো।
তিনি ছিলেন একজন বীর যোদ্ধা। তার সাহস ও শৌর্য ছিল অপরিসীম। তার তলোয়ারে ছিল লক্ষ যোদ্ধার জোর। ইসলাম গ্রহণ করার পর আল্লাহর নবী (স:)কে দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি, তবে নবীর বহু সহাবী রঃ কে তিনি দেখেছেন। তিনি একজন অসাধারণ ব্যাক্তি ছিলেন।
একদিন তার সামনে এক ব্যক্তি কোরআনের এই আয়াতটি পড়লেন-
ﻟَﻘَﺪْ ﺃَﻧﺰَﻟْﻨَﺎ ﺇِﻟَﻴْﻜُﻢْ ﻛِﺘَﺎﺑًﺎ ﻓِﻴﻪِ ﺫِﻛْﺮُﻛُﻢْۖ ﺃَﻓَﻠَﺎ ﺗَﻌْﻘِﻠُﻮﻥَ
“আমি তোমাদের প্রতি নাযিল করেছি এক কিতাব যাতে তোমাদের জন্য আছে উপদেশ (তোমাদের কথা), তোমরা কি তবুও বুঝবে না?” (সুরা আল আম্বিয়া– ১০)
আহনাফ ছিলেন আরবী সাহিত্যে গভীর পারদর্শী ব্যক্তি। তিনি ভাল করেই বুঝতেন ‘যাতে উপদেশ (তোমাদের কথা আছে) ‘ এই কথার অর্থ কি?
তিনি অভিভূত হয়ে গেলেন কেউ বুঝি তাকে আজ নতুন কিছু শোনালো! মনে মনে বললেন , “আমাদের কথা আছে? কই ক্বুর’আনআন নিয়ে আসো তো? দেখি এতে আমার কথা কি আছে?”
তার সামনে ক্বুর’আন আনা হলো, একে একে বিভিন্ন দল উপদলের পরিচিতি পেশ করা হচ্ছে–
১. একদল লোক এলো, তাদের পরিচয় এভাবে পেশ করা হলো, এরা রাতের বেলায় খুব কম ঘুমায়, শেষ রাতে তারা আল্লাহর কাছে নিজের গুনাহখাতার জন্য মাগফেরাত কামনা করে। (দেখুন সুরা আয যারিয়াতঃ ১৭-১৯)
২. আবার একদল লোক এলো, তাদের পরিচয় এভাবে পেশ করা হলো, তাদের পিঠ রাতের বেলায় বিছানা থেকে আলাদা থাকে, তারা নিজেদের প্রতিপালককে ডাকে ভয় ও প্রত্যাশা নিয়ে। তারা অকাতরে আমার দেয়া রেযেক থেকে খরচ করে। (দেখুন সুরা হা- মীম সেজদা- ১৬)
৩. কিছুদুর এগিয়ে যেতেই তার পরিচয় হলো আরেক দল লোকের সাথে, তাদের সম্পর্কে বলা হলো, রাতগুলো তারা নিজেদের মালিকের সেজদা ও দাঁড়িয়ে থাকার মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দেয়। (দেখুন সুরা আল ফোরকান- ৬৪)
৪. অত:পর এলো আরেকদল মানুষ, এদের সম্পর্কে বলা হলো, এরা দারিদ্র্য ও সাচ্ছন্দ্য উভয় অবস্থায় (আল্লাহর নামে) অর্থ ব্যয় করে, এরা রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে, এরা মানুষদের ক্ষমা করে,বস্তুত আল্লাহ তায়ালা এসব নেককার লোকেদের দারুণ ভালোবাসেন। (দেখুন সুরা আল ইমরান- ১৩৪)
৫. এলো আরেকটি দল ,তাদের পরিচয় এভাবে পেশ করা হলো, এরা (বৈষয়িক প্রয়োজনের সময়) অন্যদেরকে নিজেদেরই ওপর প্রাধান্য দেয়, যদিও তাদের রয়েছে প্রচুর অভাব ও ক্ষুধার তাড়না। যারা নিজেদেরকে কার্পণ্য থেকে দুরে রাখতে পারে তারা বড়ই সফলকাম। (দেখুন সুরা আল হাশর- ৯)
একে একে এদের সবার কথা ভাবছেন আহনাফ।
৬. এবার ক্বুর’আন তার সামনে আরেকদল লোকের কথা পেশ করলো,এরা বড়ো বড়ো গুনাহ ও নির্লজ্জ অশ্লীলতা থেকে বেঁচে থাকে, যখন এরা রাগান্বিত হয় তখন (প্রতিপক্ষকে ) মাফ করে দেয়, এরা আল্লাহর হুকুম আহকাম মেনে চলে, এরা নামাজের প্রতিষ্ঠা করে,এরা নিজেদের মধ্যেকার কাজকর্মগুলোকে পরামর্শের ভিত্তিতে আঞ্জাম দেয়। আমি তাদের যা দান করেছি তা থেকে তারা অকাতরে ব্যয় করে। (দেখুন সুরা আশ- শুরা- ৩৭,৩৮)
আহনাফ নিজেকে নিজে জানতেন। আল্লাহর কিতাবে বর্ণিত এ লোকদের কথাবার্তা দেখে তিনি বললেন, “হে আল্লাহ তায়ালা , আমি তো এই বইয়ের কোথাও আমাকে খুজে পেলাম না। আমার কথা কই? আমার ছবি তো এর কোথাও আমি দেখলাম না , অথচ এ কিতাবে তুমি নাকি সবার কথাই বলেছো।“
এবার আহনাফ ভিন্ন পথ ধরে কোরআনে নিজের ছবি খুঁজতে শুরু করলেন। এ পথে ও তার সাথে বিভিন্ন দল উপদলের সাক্ষাত হলো।
৭. তিনি পেলেন এমন একটি দল, যাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, যখন তাদের বলা হয়, অল্লাহ তায়লা ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই, তখন তারা গর্ব ও অহংকার করে এবং বলে , আমরা কি একটি পাগল ও কবিয়ালের জন্য আমাদের মাবুদদের পরিত্যাগ করবো? (দেখুনসুরা আস সাফফাত- ৩৫-৩৬)
৮. তিনি আরো সামনে এগুলেন, দেখলেন আরেকদল লোক, তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, যখন এদের সামনে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয় তখন এদের অন্তর অত্যন্ত নাখোশ হয়ে পড়ে, অথচ যখন এদরে সামনে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্যদের কথা বলা হয় তখন এদের মন আনন্দে নেচে উঠে। (দেখুন সুরা আয যুমার-৪৫)
৯. তিনি আরো দেখলেন একদল লোকদের ব্যাপারে, কতিপয় হতভাগ্য লোককে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, তোমাদের কিসে জাহান্নামের এই আগুনে নিক্ষেপ করলো? তারা বলবে, আমরা নামাজ প্রতিষ্ঠা করতাম না, আমরা গরীব মেসকীনদের খাবার দিতাম না, কথা বানানো যাদের কাজ- আমরা তাদের সাথে মিশে সে কাজে লেগে যেতাম। আমরা শেষ বিচারের দিনটিকে অস্বীকার করতাম, এভাবেই একদিন মৃত্যু আমাদের সামনে এসে হাজির হয়ে গেলো। (দেখুন সুরা আল মুদ্দাসসের, ৪২-৪৬)
আহনাফ কোরআনে বর্ণিত বিভিন্ন ধরনের মানুষের বিভিন্ন চেহারা ছবি ও তাদের কথা দেখলেন। বিশেষ করে এই শেষোক্ত লোকদের অবস্থা দেখে মনে মনে বললেন, “ হে আল্লাহ , এ ধরনের লোকদের উপর আমি তো ভয়ানক অসন্তষ্ট। আমি এদের ব্যাপারে তোমার আশ্রয় চাই”।
এ ধরনের লোকদের সাথে আমার কোনোই সম্পর্ক নেই। তিনি নিজেকে নিজে ভালো করেই চিনতেন, তিনি কোনো অবস্থাতেই নিজেকে এই শেষের লোকদের দলে শামিল বলে ধরে নিতে পারলেন না। কিন্তু তাই বলে তিনি নিজেকে প্রথম শ্রেণীর লোকদের কাতারেও শামিল করতে পারছেন না। তিনি জানতেন, আল্লাহ তায়ালা তাকে ঈমানের দৌলত দান করেছেন। তার স্থান যদিও প্রথম দিকের সম্মানিত লোকদের মধ্যে নয় কিন্তু তাই বলে তার স্থান মুসলমানদের বাইরেও তো নয়।
তার মনে নিজের ঈমানের যেমন দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো, তেমনি নিজের গুনাহখাতার স্বীকৃতি ও সমানভাবে মজুদ ছিলো। কোরআনের পাতায় তাই এমন একটি ছবির সন্ধান তিনি করছিলেন, যাকে তিনি একান্ত ‘নিজের ‘ বলতে পারেন। তার সাথে আল্লাহ তায়ালার ক্ষমা ও দয়ার প্রতিও তিনি ছিলেন গভীর আস্থাশীল। তিনি নিজের নেক কাজ গুলোর ব্যাপারে যেমন খুব বেশী অহংকারী ও আশাবাদী ছিলেন না, তেমনিভাবে আল্লাহর রহমত থেকেও তিনি নিরাশ ছিলেন না। কোরআনের পাতায় তিনি এমনি একটি ভাল মন্দ মেশানো মানুষের ছবিই খুঁজছিলেন এবং তার বিশ্বাস ছিলো এমনি একটি মানুষের ছবি অবশ্যই তিনি এই জীবন্ত পুস্তকের কোথাও না কোথাও পেয়ে যাবেন।
কেন, তারা কি আল্লাহর বান্দা নয় যারা ঈমানের ‘দৌলত’ পাওয়া সত্বেও নিজেদের গুনাহর ব্যাপারে থাকে একান্ত অনুতপ্ত। কেন, আল্লাহ তায়ালা কি এদের সত্যিই নিজের অপরিসীম রহমত থেকে মাহরূম রাখবেন? এই কিতাবে যদি সবার কথা থাকতে পারে তাহলে এ ধরনের লোকের কথা থাকবে না কেন? এই কিতাব যেহেতু সবার, তাই এখানে তার ছবি কোথাও থাকবে না- এমন তো হতেই পারে না।
তিনি হাল ছাড়লেন না । এই পুস্তকে নিজের ছবি খুঁজতে লাগলেন। আবার তিনি কেতাব খুললেন।
কোরআনের পাতা উল্টাতে উল্টাতে এক জায়গায় সত্যিই আহনাফ ‘নিজেকে‘ উদ্ধার করলেন। খুশীতে তার মন ভরে উঠলো। আজ তিনি কোরআনে নিজের ছবি খুঁজে পেয়েছেন, সাথে সাথেই বলে উঠলেন, “হ্যাঁ, এইতো আমি!”
“ হ্যাঁ এমন ধরনের কিছু লোকও আছে যারা নিজেদের গুনাহ স্বীকার করে। এরা ভালো মন্দ মিশিয়ে কাজকর্ম করে – কিছু ভালো কিছু মন্দ। আশা করা যায় আল্লাহ তায়ালা এদের ক্ষমা করে দেবেন। অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা বড়ো দয়ালু বড়ো ক্ষমাশীল।“(দেখুনসুরা আত তাওবা- ১২)
আহনাফ আল্লাহর কিতাবে নিজের ছবি খুঁজে পেয়ে গেলেন, বললেন,” হাঁ, এতোক্ষণ পর আমি আমাকে উদ্ধার করেছি। আমি আমার গুনাহর কথা অকপটে স্বীকার করি,
আমি যা কিছু ভালো কাজ করি তাও আমি অস্বীকার করি না। এটা যে আল্লাহর একান্ত দয়া তাও আমি জানি। আমি আল্লাহর দয়া ও তাঁর রহমত থেকে নিরাশ নই। “
কেননা এই কিতাবই অন্যত্র বলছে, আল্লাহর দয়া থেকে তারাই নিরাশ হয় যারা গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট। (সুরা আল হেজর- ৫৬)
আহনাফ দেখলেন, এসব কিছুকে একত্রে রাখলে যা দাঁড়ায় তাই হচ্ছে তার ‘ছবি‘।
ক্বুর’আনের মালিক আল্লাহ তায়ালা নিজের এ গুনাহগার বান্দাহর কথা তার কিতাবে বর্ণনা করতে ভুলেননি!
আহনাফ কোরআনের পাঠকের কথার সত্যতা অনুধাবন করে নীরবে বলে উঠলেন “হে মালিক, তুমি মহান, তোমার কেতাব মহান, সত্যিই তোমার এই কিতাবে দুনিয়ার গুণী-জ্ঞানী , পাপী-তাপী, ছোট-বড়, ধনী-নির্ধন, সবার কথাই আছে। তোমার কেতাব সত্যিই অনুপম”।
Post a Comment