মহাকালের বিবেচনায় সব উপলক্ষের মাঝে সর্বোৎকৃষ্ট, সম্মানের বিবেচনায় সর্বশ্রেষ্ঠ, প্রভাবের বিবেচনায় সুদূর বিস্তৃত উপলক্ষ হল সম্মানিত মাহে রমজান। যার টলটলে রস আস্বাদন করে আমরা হই পরিতৃপ্ত । চুমুকে চুমুকে তুলে নিই তার মধু। নাক ভরে শুঁকে নেই তার সুগন্ধি। মাহে রমজান সাওয়াব-পুণ্য বহুগুণে বেড়ে যাওয়ার মাস। মর্যাবান হওয়ার মাস। পাপ-গুনাহ মোচন হওয়ার মাস। পদস্খলন থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর মাস। এ মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। দোযখের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। শয়তানকে আবদ্ধ করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি এ মাসে রোজা রাখবে, তারাবি পড়বে ইমান ও সওয়াব লাভের আশায়, তার অতীত জীবনের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। সহিহ হাদিসে এভাবেই এসেছে- হযরত আবু হুরায়রা রাযি. হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি ইমান ও অনুভবের সঙ্গে আল্লাহর কাছ থেকে সাওয়াব প্রাপ্তির আশায় সিয়াম পালন করবে, তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। [বুখারি ও মুসলিম] যে ব্যক্তি ইমান ও ইহতেসাবসহ রমজানের রাত্রি যাপন করবে তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। [বুখারি ও মুসলিম]
রমজান মুসলমানদের জন্য বিশাল এক আনন্দের মাস। মহাকালের চাকায় ঘুরে ঘুরে প্রতি বছরেই আসে রমজান। আসে এই সম্মানিত মৌসুম। আসে এই মহান মাস। আসে প্রিয় মেহমান হয়ে, সম্মানিত অতিথি হয়ে। এই উম্মতের জন্য মাহে রমজান আল্লাহর এক নিয়ামত। কেননা এ মাসের রয়েছে বহু গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্য। হযরত আবু হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, এক হাদিসে এসেছে- ‘যখন রমজান আসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। দোযখের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। শয়তানকে শিকল পড়িয়ে দেয়া হয়।’ [বুখারি ও মুসলিম]
এটা নিঃসন্দেহে বড় সুযোগ। এই সম্মানিত মাস উপলক্ষে যেখানে স্বচ্ছতা পায় অন্তরাত্মা। হৃদয় আকৃষ্ট হয় যার প্রতি। বেড়ে যায় ভালো কাজ করার উৎসাহ-উদ্যম। খোলে যায় জান্নাত, নাযিল হয় অফুরন্ত রহমত ও বরকত। বেড়ে যায় মর্যাদা ও সম্মান, মাফ হয় গুনাহ ও গোস্তাকি।
রমজান তাহাজ্জুদ ও তারাবির মাস। যিকির ও তাসবিহর মাস। রমজান কুরআন তিলাওয়াত ও নামাজের মাস। দান সাদকার মাস। যিকির-আযকার ও দুআর মাস। আহাজারি ও কান্নার মাস।
প্রিয় পাঠক! জাতির জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়া জরুরি যখন আত্মার পরিশুদ্ধি ও তৃপ্তি সম্পন্ন হবে। যখন ইমানের মাইলফলকগুলো নবায়ন করা হবে। যা কিছু নষ্ট হয়েছে তা সংস্কার করা হবে। যেসব রোগব্যাধি বাসা বেঁধেছে তা সারিয়ে তোলা হবে। রমজান সেই আধ্যাত্মিক মুহূর্ত যেখানে মুসলিম উম্মাহ তাদের বিভিন্ন অবস্থা সংস্কার করার সুযোগ পায়, তাদের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানোর সুযোগ পায়। তাদের অতীতকে ফিরিয়ে আনার সুযোগ পায়। এটা আত্মিক ও চারিত্রিক বল ফিরিয়ে আনার একটি মাস। আর এ আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক শক্তি ফিরিয়ে আনা প্রতিটি জাতিরই কর্তব্য। মুসলমানরা এ মৌসুমের অপেক্ষায় থাকে অধীর আগ্রহে। এটা ইমান নবায়নের একটা বিদ্যাপীঠ। চরিত্র মাধুর্যম-িত করার সময়। আত্মাকে শান দেয়ার সময়।
আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমে আমাদেরকে প্রথমে রমজানকে স্বাগত জানাতে হবে। সকল পাপ-গুনাহ থেকে তাওবার মাধ্যমে রমজানকে স্বাগত জানাতে হবে। সকল প্রকার জুলুম অন্যায় থেকে বেরিয়ে রমজানকে স্বাগত জানাতে হবে। যাদের অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে রমজানকে স্বাগত জানাতে হবে। ভালো কাজের মাধ্যমে রমজানের দিবস-রজনী যাপনের মানসিকতা নিয়ে রমজানকে স্বাগত জানাতে হবে। এ ধরনের আবেগ অনুভূতির মাধ্যমেই আশাসমূহ পূর্ণ হয়। ব্যক্তি ও সমাজে তাদের সম্মান ফিরে পায়। এর বিপরীতে রমজান যদি কেবলই একটি অন্ধ অনুকরণের বিষয় হয়। কেবলই কিছু সীমিত প্রভাবের নিষ্প্রাণ আচার পালনের নাম হয়। যদি এমন হয় রমজানে পুণ্যের বদলে, পাপ ও বক্রতা কারও কারও জীবনে বেড়ে যায়, তবে এটা নিশ্চয়ই একটি আত্মিক পরাজয়, এটা নিশ্চয় শয়তানের নির্জলা খেলা, যার বিরূপ প্রভাব ব্যক্তি ও সমাজের উপর পড়তে বাধ্য।
এই মহান মাসের আগমনে মুসলমানদের জীবনে আসুক সুখ ও সমৃদ্ধি। সারা পৃথিবীর মুসলমানদের জীবনে এ মহান মৌসুমের আগমনে বয়ে যাক আনন্দের ফল্গুধারা। যারা আনুগত্যশীল, এ মাস তাদের নেককাজ বাড়িয়ে দেয়ার। যারা পাপী, তাদের জন্য এ মাস পাপ থেকে ফিরে আসার। মুমিন জান্নাতের দরজাসমূহের উন্মোক্তে খুশি না হয়ে পারে না? পাপী, নরকের দরজাসমূহ এ মাসে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খুশি হবে বৈ কি। এ এক বিশাল সুযোগ যা থেকে মাহরুম ব্যক্তি ছাড়াও অন্য কেউ বঞ্চিত হয় না। সিয়াম ও কিয়ামের মাস রমজানের আগমন মুসলমানদের জন্য বিরাট সুখের সংবাদ।
প্রিয় পাঠক! রমজান সম্পর্কে বেশি কিছু বলতে চাইনি। যাদের উপর রোজা ফরজ তারা রমজানে সিয়াম সম্পর্কে বেশি কিছু না জানলেও কিছু তো জানে অথবা ভালোভাবেই ওয়াকিফহাল আছেন। কিন্তু যারা আমাদের অগ্রে চলে গেছেন। যারা মহান আল্লাহর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বান্দা। যাদেরকে দেখে, চিনে বুঝে অনুধাবন করে যাদের বিনাদ্বিধায় অনুসরণ করতে পারা যায়, অথবা কেউ কেউ অনুসরণ করে চলেছেন, যাদের নাম সামনে আসলে আমাদের মন ও মগজ শ্রদ্ধা ভালোবাসা ও দোআয়ে নুয়ে আসে সেসব মহান যুগ তাপস যারা সিয়াম সাধনা করেছেন, সিয়ামের তিরিশ দিন তারা কিভাবে কাটিয়েছেন, সে সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনার কিছু নির্যাস মলাটবদ্ধ করে আমাদেরকে জানার এবং পালন করার সুযোগ করে দিয়েছেন মাওলানা জাকারিয়া কান্ধলভি রহ. তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আকাবির কা রমজান’- এর মাধ্যমে।
মাওলানা আমিন আশরাফ
লেখক, আলেম ও অনুবাদক
Post a Comment