রোজা ইসলামের অন্যতম ফরজ বিধান। রোজা বা সিয়াম সাধনা আল্লাহর অন্যতম বিধান যা শুধু ইসলামের বিধান নয়, পূর্ববর্তী ধর্মগুলোতেও এই বিধান ছিল। রোজা হলো একটি অপ্রকাশ্য ইবাদত। আর নামাজ ও হজ্ব দৃশ্যমান ইবাদত। যদিও ব্যক্তিজীবন, সমাজ উন্নয়ন ও মানবতার সেবায় রোজার বহুদা উপকারিতা রয়েছে। তথাপি রোজার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো তাকওয়া অর্জন।
তাকওয়া অর্থ বাঁচা, আত্মরক্ষা করা, নিষ্কৃতি লাভ করা, ভয় করা। অর্থাৎ আল্লাহর ভয় ও তাঁর সন্তুষ্টি লাভের আশায় অপরাধ, অন্যায় ও আল্লাহর অপছন্দনীয় কথা, কাজ ও চিন্তা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার নাম তাকওয়া। একদা হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে হজরত ওমর (রা.) তাকওয়ার স্বরূপ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, ‘হে ওমর (রা.)! পাহাড়ের দুই ধারে কাঁটাবন, মাঝখানে সরু পথ। এমতাবস্থায় কিভাবে চলতে হবে? হজরত ওমর (রা.) বললেন, গায়ে যেন কাঁটা না লাগে, সাবধানে পথ চলতে হবে। হজরত কাব (রা.) বললেন, ‘এটাই তাকওয়া।’ কেউ কেউ বলেন, তাকওয়া হলো অন্তরের জ্যোতি বা উজ্জ্বলতার নাম, যার মাধ্যমে বান্দা সঠিক পথ ও কর্মপন্থা বেছে নিতে পারে।
তাকওয়ার গুরুত্ব বোঝাতে পবিত্র কোরআনে প্রায় আড়াই শতাধিক আয়াত আনা হয়েছে। কেবল সুরা বাকারাতেই প্রায় ত্রিশবার তাকওয়া শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। মূলত তাকওয়াই হলো ইবাদতের প্রাণশক্তি। এ জন্য পবিত্র কোরআনে প্রায় প্রতিটি বিধিবিধানের পরই তাকওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এমনকি তাকওয়াবিবর্জিত ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ মুত্তাকিদের আমলই কবুল করেন।’ (সুরা মায়েদা : ২৭)
মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র আল কুরআনের সূরা বাকারাহ’র ১৮৩তম আয়াতে ইরশাদ করেছেন-
ﻳَﺎ ﺃَﻳُّﻬَﺎ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺁَﻣَﻨُﻮﺍ ﻛُﺘِﺐَ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢُ ﺍﻟﺼِّﻴَﺎﻡُ ﻛَﻤَﺎ ﻛُﺘِﺐَ
ﻋَﻠَﻰ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻣِﻦْ ﻗَﺒْﻠِﻜُﻢْ ﻟَﻌَﻠَّﻜُﻢْ ﺗَﺘَّﻘُﻮﻥَ ( 183 )
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা পরহেজগারী অর্জন করতে পার।” (২: ১৮৩)
হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
ﺇﺫﺍ ﺟﺎﺀ ﺭﻣﻀﺎﻥ ﻓﺘﺤﺖ ﺃﺑﻮﺍﺏ ﺍﻟﺠﻨﺔ، ﻭﻏﻠﻘﺖ ﺃﺑﻮﺍﺏ ﺍﻟﻨﺎﺭ، ﻭﺻﻔﺪﺕ ﺍﻟﺸﻴﺎﻃﻴﻦ .
যখন রমজান মাসের আগমন ঘটে, তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শয়তানদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়।-সহীহ বুখারী, হাদীস-১৮৯৮, সহীহ মুসলিম, হাদীস-১০৭৯ (১), মুসনাদে আহমদ হাদীস-৮৬৮৪, সুনানে দারেমী, হাদীস-১৭৭৫
পৃথিবীতে কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। সব কিছুই পরিবর্তনশীল। বরং পরিবর্তনশীলতাই কেবল স্থায়ী। পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাও মানুষকে সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায়। পরিবর্তন বা সংস্কারের লক্ষ্যে যুগে যুগে আবির্ভাব ঘটে মুজাদ্দিদ বা সংস্কারকের।
যদিও যেকোনো অবস্থার বদল বা রূপান্তরকেই পরিবর্তন বলে। তথাপি যে পরিবর্তন কাম্য তা হলো, অনুন্নত জীবন থেকে উন্নত জীবনে, নিরানন্দময় জীবন থেকে আনন্দময় জীবনে, অভিশপ্ত জীবন থেকে সৌভাগ্যময় জীবনে, আশাহত জীবন থেকে আশান্বিত জীবনে, অসৎ জীবনযাপন থেকে সৎ জীবনে, গোমরাহির পথ থেকে হেদায়েতের পথে রূপান্তর ও অবস্থান্তরকেই বোঝায়। কিন্তু কথা হলো, এ পরিবর্তনটা কোত্থেকে শুরু হবে। মূলত পরিবর্তনটা শুরু করতে হবে নিজ থেকে, স্বীয় অন্তর থেকে।
হেদায়েত ও নেককাজের পথে মানুষের শত্রু হলো দুটি। একটি হলো শয়তান, অন্যটি নফস বা মানবমন। শয়তান সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শক্র।’ (সুরা ইয়াসিন : ৬০) নফস সম্পর্কে কোরআনের ভাষ্য হলো, ‘নিশ্চয়ই মানুষের নফস বা মন মন্দ কর্মপ্রবণ।’ (সুরা ইউসুফ : ৫৩) পবিত্র মাহে রমজানে শয়তানকে কুদরতিভাবে বন্দি করে রাখা হয়।
আত্মার শক্তি যখন তার মধ্যে প্রবল হয়, তখন সে মারেফতে এলাহি অর্জনে সক্ষম হয়। এমনকি উৎকর্ষতার বিচারে ফেরেশতাকুলকেও ছাড়িয়ে যায়। রমজানের কর্মসূচি মানুষকে জাগতিকতা থেকে আধ্যাত্মিকতা এবং দেহশক্তি থেকে আত্মার উৎকর্ষতা অর্জনে সাহায্য করে। আল্লাহ তাআলা আমাদের রমজানের যাবতীয় কল্যাণ নসিব করুন। আমিন।
Post a Comment